কলকাতা থেকে শুরু একটি ঐতিহাসিক যাত্রাপথের গল্প
🌅 প্রথম আলোয় কলকাতা ছাড়লাম
সকালের কোমল আলো ফুটে উঠেছে কলকাতায়। ট্রেনটা হাওড়া ছাড়তেই জানলার বাইরে ছুটে যেতে লাগল শহরের ব্যস্ততা। উঁচু ইমারতগুলো যেন ধীরে ধীরে পেছনে চলে যেতে লাগল, আর তার জায়গায় ভরে উঠল বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতি। জানালায় বসে দেখি কাঁচের ওপারে বাংলার সবুজ মাঠ, নদী আর ধূসর কুয়াশা যেন একে একে ছুটে আসছে।
বাইরে যেন খেলা করছে ঋতুর খেয়াল — কখনো কোমল সূর্যকিরণ, কখনো হঠাৎ ছায়া ফেলছে ভেসে আসা মেঘ। ট্রেনের জানলার পাশে বসে আমি যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম সেই কোমল আলো, মাটির গন্ধ, আর মাঠের ছড়িয়ে থাকা রঙিন ফুলের মাঝে।
প্রকৃতি যেন ক্যানভাসে আঁকা একটি জলরঙের ছবি। চারপাশে সোনালি আর সবুজ ধানের ক্ষেত, দূরে সারি সারি তালগাছ, পুকুরের শান্ত জল, আর শীতল বাতাসে দুলতে থাকা শিমুল আর কদমগাছ। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি এলো — জলকণায় ঝাপসা হয়ে উঠল ট্রেনের জানলা। ট্রেনের ছন্দময় শব্দের সঙ্গে মিশে গেল বৃষ্টির মৃদু টাপুরটুপুর, যেন কোনো প্রাচীন গানের মূর্ছনা। যেন প্রকৃতিই খেলায় মেতেছে।
কৃষকেরা ছাতা মাথায় মাঠ ছাড়ছে, শিশুরা কাদায় ছুটোছুটি করছে — এ যেন বাংলার আসল সৌন্দর্য। মাটির সুবাস, ভেজা বাতাস — ট্রেনের কামরায় বসে বসে এক প্রশান্তি যেন মনের গভীরে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
ট্রেন যখন বড় স্টেশনগুলো পেরোয় — হাওড়া, বর্ধমান — তখন যেন শহুরে কোলাহল মুহূর্তের জন্য ফিরে আসে। চায়ের দোকানে ভিড়, দৌড়ে এসে কামরায় উঠছে যাত্রীরা। তারপর আবার ট্রেন ছুটে চলে ফাঁকা ট্র্যাক ধরে, যেন পৃথিবীটা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেছে।
সেই ছন্দময় ছুটে চলা, জানালায় ঠেকা মুখ, ভেজা মাঠের সবুজ, মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে যাওয়া — এক অপূর্ব শান্তি মিশে থাকে এই ভ্রমণে।
ট্রেনের কামরায় অনেক ধরনের যাত্রী — কেউ অফিসফেরতা, কেউ আত্মীয়বাড়ি যাচ্ছেন, আবার কেউ আমারই মতো অজানা পথে নতুন অভিজ্ঞতার খোঁজে। পানাগড় স্টেশনে নেমে শুরু হলো পরবর্তী অধ্যায়।
অবশেষে পৌঁছালাম পানাগড়ে। সেখান থেকে বাসে ১১ মাইল পেরোতে পেরোতে চোখে পড়ল গাছগাছালির সারি, হালকা ঢেউ খাওয়া রাস্তায় বাসের ছন্দময় দুলুনি। একটি টোটো ভাড়া করে পৌঁছে গেলাম মেধস আশ্রমে। আশ্রমের চারপাশে সবুজে ঘেরা এক শান্ত নিস্তব্ধতা। যেন ভ্রমণটা শুধু শরীরের নয়, মনেরও। সবুজের রাজ্যে পা ফেলতেই অনুভব হলো যেন সময়ের চাকা উল্টে গেছে। চারপাশে ঘন গাছপালা, পাখির কূজন, স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ — যেন প্রকৃতি নিজে গল্প শোনাচ্ছে বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস।
মেধস আশ্রম দর্শন করে পায়ে হেঁটে পেরোলাম গড় জঙ্গলের পথে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বুনো ফুল, কুয়াশায় ঢাকা ছোট ছোট টিলা, পাখিদের গান যেন এই পথকে আরও রহস্যময় করে তুলল। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম ইছাইঘোষ দেউল।
শ্যামরূপা মন্দির চত্বরে Watch Tower এর পাশে একটুকরো ঢালু পথে চোখে পড়ল সেই রহস্যময় সুরঙ্গপথের সামনে — যা নাকি বঙ্কিমচন্দ্রের “দেবী চৌধুরানী”-র সঙ্গে জড়িত। চারপাশে ঘন জঙ্গলে ঢাকা এ স্থান যেন শত শত বছরের ইতিহাসকে আগলে রেখেছে।
সুরঙ্গপথটা অনেকটা নিচু, চারপাশের ঝোপঝাড়ের ভেতর যেন লুকিয়ে থাকা এক পুরোনো রহস্য। মুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন গল্পের পাতায় হারিয়ে যাচ্ছি — যেন আজও এখানে দেবী চৌধুরানীর পায়ের ছাপ লেগে রয়েছে।
সুরঙ্গপথের রহস্য উন্মোচন করে পায়ে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম ইছাইঘোষ দেউল মন্দিরে। চৌহদ্দি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক ইটের দেয়াল, চারপাশে সবুজ প্রকৃতি আর বিকেলের কোমল আলো যেন মনটাকে উদাস করে দেয়।
ট্রেনে করে ফিরতে ফিরতে মনে হলো, এ ভ্রমণ যেন এক অনন্য গল্পের অধ্যায়, যা বাংলার ইতিহাস, প্রকৃতি, ঋতুর খেয়াল এবং মানুষের জীবনযাত্রা একসাথে মিশিয়ে দিলো। মনে হচ্ছিল আজকের যাত্রা যেন শুধুই ভ্রমণ নয়, এক ধরনের আত্মঅন্বেষণ। বাংলার ইতিহাস, প্রকৃতি আর মানুষের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছি। প্রকৃতি, ঋতুর খেয়াল এবং মানুষের জীবনযাত্রা একসাথে মিশিয়ে দিলো।
শহরের কোলাহল আবার কাছে আসছে, তবে মনের মধ্যে থেকে যাবে সেই সুরঙ্গপথের রহস্য, মাঠের সবুজ, ইছাইঘোষ দেউল, এবং ইতিহাসের পাতায় লেখা এক মায়াবী দিনের স্মৃতি।💌 আরও এমন ভ্রমণগল্প পেতে সঙ্গে থাকুন!
💬 আপনারও কি বাংলায় এমন প্রিয় কোনও ঐতিহাসিক স্থান আছে? শেয়ার করুন কমেন্টে!
No comments:
Post a Comment