মুকুজ্জে বাড়ির আগমনী
|| গল্পসংকলন পর্ব ||
এদিকে ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে দশটা। তবে আইএসডি না , পি এস টি , অর্থাৎ প্যাসিফিক স্ট্যান্ডার্ড টাইম, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন আমি এখন ক্যালিফোর্নিয়াতে। আমি এখানে কিভাবে কেন সে কথা আপনাদের অবশ্যই বলব কিন্তু তার আগে আমার একটু খানি ছোটবেলার পরিচয়টা আপনাদের দিয়ে দিন। আমার জন্ম বেড়ে ওঠা ছোটবেলার পড়াশোনা সবই উত্তর কলকাতার বাগবাজার, আর উত্তর কলকাতার বাগবাজারে ঠিক তার উল্টো দিকে আমাদের বাড়ি সাবেকি বাড়ি। সেখানে ঠিক এখনো পর্যন্ত হিসাবে কি নিয়ম পালন করে ডাকের সাজে সেজে মা দুর্গা আমাদের বাড়িতে এসে পড়েন তার সময়মতো আগমনীতে।
কোলের MacBook এর স্লাইড টা বন্ধ করে কফির কাপটা হতে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে কফিতে দেয় চুমুক দেয় অভিরাজ Mukherjee।
ঠিক সেই সময়ই মাথার উপর দিয়ে একটা বিমান দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে এক দেশের সীমানা থেকে আরেক দেশের সীমানার দিকে।
ডিউটিতে এখন খুবই চাপ। কিন্তু দাদুর নির্দেশ অমান্য করা যায় না । এইমাত্র স্কাইপে দাদু ভিডিও কল করে বলেছে যে বাড়ির পুজোতে নাইলে কিন্তু আর কোনদিন মুখ দেখবো না । এদিকে ছুটি জোগাড় করাটা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার তার ওপরে এই প্যানডেমিক সিচুয়েশনে । উপরন্তু একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বারবার চিন্তা করতে থাকে যে কিভাবে সবদিক বজায় রেখে অন্তত একবার হলেও তাদের সঙ্গে দেখা করে পুজোতে অন্তত একদিন হলেও কাটিয়ে যেন সেখানে আসতে পারে । আবার পরক্ষনেই এইটা মনে পড়ে যায় যে ছোটবেলা থেকে যতদিন পর্যন্ত তারা বাড়িতে ছিল একসাথে ততদিন মহালয়ার সবাই কিন্তু ভোরবেলা চারটের সময় উঠিয়ে রেডিওতে শুনে এসেছে সেই ভদ্র মহাশয়ের অমৃত কন্ঠে।
তথাপি দাদুর নির্দেশমতো মহালয়ার আগের দিন হাজির তাকে হতেই হবে।
আবার ভাবতে থাকি যাবে যখন এই সুযোগে এইবারে এরিনাকে নিয়ে গিয়ে বাড়ির সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে । তাও বলতে গেলে বছর আড়াই তো হয়েই গেল তারা দুজন লিভিং এ রয়েছে । তাই বাড়িতে বলে এবার সম্পর্কটা একটা পাকাপাকি রূপ দেয়া যেতেই পারে । আর এরিনাও বাঙালি কালচার টা বেশ পছন্দ করে ।
সাথে সাথে আর কিছু না ভেবেই অরিনকে বলে, বেবি, স্টার্ট প্যাকিং। we are গোয়িং টু কলকাতা ।
এরিনা এটা শুনে এতটাই এক্সাইটেড হয়ে পড়ে যে কি বলব সেটা আপনাদের না দেখালে বিশ্বাস করাতে পারবো না।
সাথে সাথেই ব্যাকপ্যাকিং কমপ্লিট করার পরেই ফ্লাইট এর টিকিট বুক করে পাসপোর্ট-ভিসা সবকিছু রেডি করে টিক দিন চারেক পরে আমরা দুজন মিলে পৌঁছায় নিউইয়র্ক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ । সেখান থেকে প্রথমে যাব দুবাই তারপর সেখান থেকে ভারতের ফ্লাইট ধরে দিল্লি দিল্লি থেকে সোজা কলকাতা।
এরিনার ইচ্ছা অনুযায়ী কলকাতা এসে airport থেকে অ্যাপ ক্যাব ছেড়ে হলুদ ট্যাক্সি করে আমরা দুজনে পৌঁছে যাই আমাদের সেই বাগবাজারের সাবেকি বাড়িতে।
বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে প্রথমেই আমাদের দুর্গা মন্দির তার পরে উঠান পার করে দালান, পড়ে বাম হাতের সিড়ি ধরে দোতলায় আমার ঘর।
দাদু এরিনা কে দেখে জোরে হেসে আমার মা কে ডেকে বলে, দেখো বৌমা, তোমার ছেলে সাথে করে কাকে নিয়ে এসেছে। দেখলে তো, বিশ্বাস হলো তো এখন, আমি তো ওই জন্যই বলেছিলাম, নাতি আমার দেশের বাড়ি আসতে চাই না কেন।
দাদু এরিনার দিকে এগিয়ে গিয়ে সস্নেহে এরিনার চিবুক খানি ধরে বলে, হ্যাঁ গো মা, আমার এই বাঁদর নাতিটাকে কিভাবে মনে ধরলো তোমার ।
অভীরাজ একটু লজ্জা মুখে হাসি হেসে বলে, তুমি না দাদু আর পাল্টালে না।
দাদু তখন বলে, তুই চুপ করতো, আমাদের দাদু নাতবৌ এর কথার মধ্যে তুই একদম আসবি না।
এই,.. এই .... এ বৌমা কোথায় গেলে, নিয়ে যাও এদের ঘরে নিয়ে গিয়ে একটু জলখাবার করে দাও, অনেক দূর থেকে এলো, বেচারা ছেলে মেয়ে দুটো আলা হয়ে গেছে একদম।
যা বাবা যা ওকে নিয়ে যা।
তা যায় হোক, একথা সেকথায় দিনটা কেটে গেলো।
এদিকে রাত পোহালেই মহালয়ার। অর্থাৎ ভোর বেলা উঠে রেডিও তে মহালয়ার শোনা তো রয়েইছে, তার সাথে রয়েছে দেবীর চক্ষু দানের পালা, আর দেবী পক্ষের সূচনা । তার পরেই বোধন হতে হাতে মাত্র গোনা সাত টা দিন।
কালের নিয়মে সেই সাত দিন পার করে হঠাৎ করে ঢাকের কাঠির dhang কুরা কুর শব্দ কে সাক্ষী রেখে উলু ধ্বনির সাথে মা এসে উপস্থিত হলেন মুকুজ্জে বাড়ির ঠাকুর দালানে।
দেখতে দেখে সপ্তমী পার করে এসে পড়লো অষ্টমী । এই দিন আমাদের বাড়ির সব মেয়েরা লাল টুকটুকে শাড়ি তে সাজে আর ছেলেরা হলুদ পাঞ্জাবী সাথে সাদা ধুতি। এটাই আমাদের বাড়ির বরাবরের নিয়ম ।
সেই নিয়ম মত এরীনাও আজকে সেজেছে লাল টুকটুকে শাড়িতে। অভিরাজ এই প্রথমবারের মতো এরিনাকে শাড়িতে দেখে মনোমুগ্ধএর মত তার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে এরিনার মাথার খোঁপায় গোঁজা গোলাপ, কপালে একটা ছোট্ট লাল রঙের টিপ, চোখে কালো কাজল, ঠোটে গোলাপি লিপস্টিক, কানে ঝুমকো কানের দুল, কোমরে সোনালী গোট, পায়ের ঝুম ঝুম আর তার সাথে এই লাল শাড়িতে, যা তাকে এক অপরূপ পরীর রূপ দিয়েছে ।
এর পর অষ্টমী পুজোয় সবাই একসাথে অঞ্জলী দিয়ে লুচি খাবার পালা ।
এর পর নবমী, আজ ওকে নিয়ে একটু বের হবো উত্তর থেকে দক্ষিণে প্যান্ডেল hoping করাতে। ব্যাস রাত পোহালেই আবার কালের নিয়মে বিদায় দেবার পালা।
ভেবেই মনটা ভারী হয়ে উঠতে থাকে।
কিন্তু বিদায় যে দিতেই হবে।
দশমীর পূজা শেষ করে মা কে মিষ্টি মুখে বিদায় জানানোই রীতি। বিষাদ মনেও একটু আনন্দের হাত ছানি তে সিঁদুর খেলা... তার পরেই “ মা আসিস তুই বছর পড়ে। থাকবো তোর অপেক্ষাতে ” |
আর বিজয়ার পরের দিন, ..... আবার যে ফিরতে হবে .….. সেই বিদেশ বিভূঁইয়ে .... কর্ম কাণ্ডে....
আর যাবার সময় ফাঁকা ঠাকুর দালানটার সামনে দাড়িয়ে দাদু শুধু একবার এরিনাকে বলে.... মা আসিস ফিরে আবার আমার এই ঘরটিতে আলো করে ।
No comments:
Post a Comment